কুরুলুস উসমান সিজন ৪ এ উসমান গাজির নেতৃত্যে যে যুদ্ধ গুলো দেখানো হবে
সুগুতে জায়গির প্রতিষ্ঠা করার পরই আরতুগরুল গাজি তার জায়গিরের সীমানা বর্ধিত করতে পার্শ্ববর্তী বাইজেনটাইন সাম্রাজ্যের বিভিন্ন ভূমি ও দুর্গের ওপর হামলা চালিয়ে দখল করতে থাকেন; উসমান গাজিও কায়ি গোত্রের নেতা হওয়ার পর এ ধারা অব্যাহত রাখেন। বিশেষ করে তিনি তার ঘোর বিরোধী বাইজেনটাইন সাম্রাজ্য ও তুর্কমেনি রাজ্যগুলো বিজয়ে তৎপর হয়ে ওঠেন।
সে হিসেবে সর্বপ্রথম যে অভিযান তিনি পরিচালনা করেন, তা ছিল বাইজেনটাইনদের বিরুদ্ধে প্রতিশোধমূলক যুদ্ধ। কেননা ১২৮৪ বা ১২৮৫ সালে তিনি আরমেনি বালা যুদ্ধে বাইজেনটাইনদের হাতে পরাস্ত হয়েছিলেন। সে যুদ্ধে তার ভাই সাভুজি বেগের সন্তান সারুখান বেগ খাজা শহিদ হয়েছিলেন। এজন্য ১২৮৬ সালে তিনশ যোদ্ধার একটি দুর্ধর্ষ বাহিনী নিয়ে কুকাচা হিসার দুর্গ অভিমুখে রওনা হন। এই দুর্গটি ইনাহগোল শহর থেকে দূরে আমির তাগ পাহাড়ের পাদদেশে অবস্থিত। রাতের আঁধারেই তিনি দুর্গের ওপর চড়াও হন এবং বিজয়ামালা ছিনিয়ে আনেন; এতে করে ইজনিক হ্রদের দিকে তার জায়গিরের সীমা আরও বর্ধিত হয়।
বাইজেনটাইনদের পক্ষ থেকে নিয়োজিত কুলাচা হিসার দুর্গের গভর্নর এ পরাজয় মেনে নিতে পারেননি। সেলজুক সাম্রাজ্যের পক্ষ থেকে একজন সামান্য সীমান্তরক্ষী-নেতার বশ্যতা স্বীকার করতে তার আত্মমর্যাদা সায় দেয় না। কালবিলম্ব না করে সে কারাচা হিসার দুর্গের শাসকের সাথে আঁতাত করেন। বিলেচিক ও ইনাহগোলের মাঝামাঝি আকজাজা প্রান্তরে তারা উসমান গাজির বাহিনীর সাথে লড়াইয়ে অবতীর্ণ হন। রক্তক্ষয়ী এ যুদ্ধে উসমানের সহোদর সাভচি বেগ শাহাদাতের অমিয় সুধা পান করেন।
শেষ পর্যন্ত বিজয় উসমানদেরই পদচুম্বন করে। ফটক খুলে দুর্গ-অভ্যন্তরে প্রবেশ করে উসমানের বাহিনী; হত্যা করে বাইজেনটাইন সেনাপতি ব্যালাটসকে। শহরের গির্জাকে তারা মসজিদে রূপান্তর করে। আদায় করে জুমার নামাজ। শহরে একজন বিচারপতি ও শাসক নিযুক্ত করা হয়। উসমানি ইতিহাসে এটিই প্রথম মসজিদ, যেটি গির্জা থেকে মসজিদে রূপান্তরিত হয়েছে। এতে সকলেই প্রকাশ্যভাবে উসমানের শক্তি, দাপট ও ক্ষমতার ঝলক দেখতে পায় ৷
উসমানের এ বিজয় ছিল অনেক বড় অর্জন। তখন সেলজুক-ই-রোমের মসনদে ছিলেন সুলতান তৃতীয় আলাউদ্দিন কায়কোবাদ। সেলজুকদের ও ইসলামের পক্ষ হয়ে উসমানের এ বিজয়ে তিনি অত্যন্ত খুশি হন এবং উসমানকে সম্মানিত করেন। তাকে বেগ, শাহ ও গাজি উপাধিতে ভূষিত করেন। বিজিত ভূমি পুরোটাই তাকে দিয়ে দেন। পাশাপাশি ইনোনু ও এসকিসেহিরও দান করেন।
এতে করে উসমানের জায়গিরের পরিধি আরও বেড়ে যায়। বেশ কিছু দামি উপঢৌকন তার কাছে প্রেরণ করেন। সেগুলো ছিল : একটি স্বর্ণের যুদ্ধপতাকা, বড় তবলা, মাথার ব্যাজ, পাখির পালকগুচ্ছ, স্বর্ণের তরবারি, রুপার তৈরি জিন, এক লাখ রৌপ্যমুদ্রা। এগুলো বহন করে নিয়ে যান সেলজুক উজির আবদুল আজিজ বেগ, কারাচা বলবন চাবিশ ও আক তৈমুর। শুধু তা-ই নয়, উসমানের অনুগত অঞ্চলসমূহের মসজিদগুলোতে জুমার খুতবায় তার নাম পাঠ, তার নামে মুদ্রা চালু করার আনুষ্ঠানিক অনুমতি প্রদান করেন। এতে করে উসমান লাভ করেন একজন সুলতান বা বাদশার পদমর্যাদা।
বর্ণিত আছে, যখন উসমান গাজির সামনে তবলা বাজানো হয়, তখন তিনি সেলজুক সুলতানের সম্মানে দাঁড়িয়ে যান; যতক্ষণ পর্যন্ত সৈন্যরা তবলা বাজায়, ততক্ষণ তিনি ঠায় দাঁড়িয়ে থাকেন। সেদিন থেকেই উসমানি সামরিক বাহিনী সুলতানের সম্মানে তবলা বাজানো এবং সেই সাথে দাঁড়ানোর রেওয়াজ চালু করে।
কারাচা হিসার জয়ের পর উসমান গাজি তার বাহিনী নিয়ে সাকারয়া নদীর উত্তরাংশের দিকে অগ্রসর হন এবং গুইনুক ও ইয়েনিচা তারাকালি দুর্গদ্বয়ের ওপর হামলা করে বসেন। অনেক গনিমত হাসিল হয়। এ সময় উসমান গাজি তার বাইজেনটাইন বন্ধু হ্যারমাঙ্কার শাসক কাসেহ মিখাইলের পক্ষ থেকে একটি সতর্কবার্তা পান।
সেই সতর্কবার্তার সারসংক্ষেপ হলো— বিলেচিক ও ইয়ার হিসার দুর্গের অধিপতিদ্বয় উসমান গাজির বিরুদ্ধে একটি গোপন ফন্দি এঁটেছে। আর তা হলো, তারা বিলেচিক দুর্গে অনুষ্ঠাতব্য তাদের ছেলে ও মেয়ের বিয়ের অনুষ্ঠানের দিন ধার্য করেছে এবং এতে উসমান গাজিকে বিশেষ দাওয়াত করেছে। উসমান গাজি সেখানে উপস্থিত হলে, তাকে গ্রেফতার করা হবে এবং তাকে হত্যা করা হবে।
সতর্ক হয়ে গেলেন উসমান গাজি। তিনি সামরিক গুপ্তচরবৃত্তির আশ্রয় নিলেন। অশ্বারোহী বাহিনীর দুর্ধর্ষ চল্লিশ জন অশ্বারোহীকে নারীর বেশ ধারণ করিয়ে বিলেচিক দুর্গের ওই বিয়ের অনুষ্ঠানে পাঠিয়ে দিলেন। সেখানে পৌঁছামাত্রই তারা এদের দুরভিসন্ধি আবিষ্কার করে ফেলল। অস্ত্রের মুখে আগত সকল অতিথিকে গ্রেফতার করে নিল। গ্রেফতারকৃতদের মধ্যে দুলহা ও দুলহানও ছিল। তখনই বিলেচিক দুর্গ বিজিত হয়ে গেল।
এ যুদ্ধে একজন নারী বন্দি হন। বলা হয়, তিনি বার্সার গভর্নর ট্যাগতরের কন্যা। নাম হ্যালভারা। পরবর্তীকালে তাকে ইসলামে দীক্ষিত করে নাম রাখা হয় নিলুফার খাতুন। উসমান গাজি তার ছেলে উরখানের জন্য তাকে পছন্দ করেন। উরখান নিলুফারকে বিয়ে করেন। নিলুফারের কোল আলোকিত করে এক ছেলের জন্ম হয়— উসমানি সুলতান প্রথম মুরাদ খান। এই নিলুফারই উসমানি রাজপ্রাসাদের প্রথম বিদেশি নারী।
ন্যায়ের ধ্বজাধারী উসমান
কাবাচা হিসার দুর্গটি অবস্থিত বাইজেনটাইন ভূমিতে। জায়গিরের আয়তন বিস্তৃত করার ধারাবাহিকতায় ১২৮৫ বা ১২৮৬ সালে এটি জয় করেন উসমান গাজি। তখন তিনি নওজোয়ান। এই দুর্গ জয় করার পর এমন এক ঘটনা সংঘটিত হয়, যা উসমান গাজির ন্যায়নীতির একটি জ্বলন্ত উদাহরণ হয়ে ইতিহাসের পাতায় ঠাঁই করে নেয়া।
বসে আছেন উসমান গাজি। ইত্যবসরে আগমন ঘটল পরস্পর বিবাদকারী দুজন লোকের। একজন মুসলিম, অপরজন খ্রিস্টান। একে অপরের বিরুদ্ধে অভিযোগ উত্থাপন করল। দুজনই বিচায় চায় উসমানের কাছে। উসমান গাজি সাক্ষ্য-প্রমাণ দ্বারা বুঝতে পারলেন—মুসলিম ব্যক্তিই অপরাধী, খ্রিস্টান লোকটি নিরপরাধ। তাই তিনি খ্রিস্টান লোকটির পক্ষেই ফয়সালা করলেন।
ফয়সালা শুনে তো খ্রিস্টান ব্যক্তি হতবাক। নিজের কানকে যেন বিশ্বাস করতে পারল না! মুসলিম ব্যক্তির বিপক্ষে ফয়সালা যাবে- এটা সে কল্পনাও করতে পারেনি। সে মনে করেছিল— খ্রিস্টান বলে উসমান গাজি কখনো তার পক্ষে ফয়সালা দেবেন না; মুসলিম শাসক হিসেবে স্বজনপ্রীতি করবেন। এজন্য তার কাছে বিচার চাইতে তেমন আগ্রহীও ছিল না। বলতে গেলে একপ্রকার জোর করেই মুসলিম লোকটি নিয়ে এসেছে।
খ্রিস্টান ব্যক্তির আশ্চর্যের ঘোর কাটেনি তখনো। তার চেহারার অবস্থা দেখে উসমান সবই বুঝতে পারছিলেন। সে উসমান গাজিকে প্রশ্ন করে বসল, “আমি বিধর্মী হওয়া সত্ত্বেও আপনি কেন আমার পক্ষে ফয়সালা করলেন?’
‘আমি কীভাবে তোমার পক্ষে ফয়সালা না করি? আমরা যে আল্লাহর ইবাদত করি, তিনি তো কুরআনুল কারিমে আমাদের নির্দেশ দিয়েছেন—“নিশ্চয় আল্লাহ তাআলা তোমাদের আদেশ দিচ্ছেন, তোমার আমানতসমূহ তার প্রাপকদের নিকট পৌঁছে দেবে এবং যখন তোমরা বিচার করবে, তখন অবশ্যই ন্যায়পরায়ণতার সাথে বিচার করবে।”
কথাটি খ্রিস্টান লোকটির মনে বজ্রাঘাতের মতো আঘাত হানল। শুনে আরও দ্বিগুণ আশ্চর্য হলো লোকটি। সে আর আর দেরি করল না; তৎক্ষণাৎ কালিমা পড়ে ইসলামের সুশীতল ছায়ায় আশ্রয়গ্রহণ করে নিজেকে ধন্য করে নিল।