সিরিজ ইতিহাস

বাস্তব ইতিহাসের আলোকে বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যের ইতিহাস

পূর্বকথন

রোমান সাম্রাজ্য পৃথিবীর এক বিস্ময়! ইউরোপ ও আফরিকা ছাপিয়ে এর বিস্তৃতি ছিল। এশিয়া পর্যন্ত। আটলান্টিক মহাসাগর থেকে ইউফ্রেটিস নদী পর্যন্ত ছিল এর বিশাল ভূখণ্ড।

বিরাট এ সাম্রাজ্য আজও অজস্র মানুষের কৌতূহলের বিষয় হয়ে আছে। ইতিহাস ও সাহিত্যের বিষয় হয়ে রোমান সাম্রাজ্য উঠে এসেছে নানাভাবে অনিবার্য বিবেচনায়। সেসব পাঠে উত্থানের গাথা যেমন লিপিত হয়েছে, রচিত হয়েছে পতনের খতিয়ানও। সব রাজ্যেরই যেমন বিলয় ঘটে, বিশাল এ সাম্রাজ্যেরও পতন হয়েছিল। ৪৭৬ সালে—রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জন্মেরও প্রায় শত বছর পূর্বে।

রোমান সাম্রাজ্য দুই ভাগে বিভক্ত ছিল— পশ্চিম রোমান সাম্রাজ্য আর পূর্ব রোমান সাম্রাজ্য। তবে রোমান সাম্রাজ্য বলতে বোঝানো হয় পূর্ব রোমান সাম্রাজ্যকেই। পশ্চিম রোমান সাম্রাজ্য ৪৭৬ খ্রিস্টাব্দে বিলুপ্ত হয়ে ইতিহাসের আস্তাকুঁড়ে নিক্ষিপ্ত হয়। এরপর পূর্ব রোমান সাম্রাজ্যই ধরে রাখে রোমান সাম্রাজ্যের যাবতীয় স্মৃতি ও ঐতিহ্য। বলা বাহুল্য, পূর্ব রোমান সাম্রাজ্য পরিচিত বাইজেনটাইন সাম্রাজ্য নামেও। ইতিহাসপাঠক বিনে এ তথ্য বিদিত নয়। এটি বিলুপ্ত হয় ১৪৫৩ খ্রিস্টাব্দে উসমানি সুলতান মুহাম্মদ আল-ফাতিহের হাতে। এই পূর্ব রোমান সাম্রাজ্য তথা বাইজেনটাইন সাম্রাজ্যকেই ইসলামের ইতিহাসে রোম বলে অভিহিত করা হয়। এর কথাই উল্লেখ হয়েছে পবিত্র কুরআনে।

ইসলামের অভ্যুদয়কাল থেকেই রোমান সাম্রাজ্যের সাথে মুসলমানদের লড়াই চলে আসছিল। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জীবদ্দশাতেই রোমকদের সাথে সংঘটিত হয়েছিল ঐতিহাসিক মুতার যুদ্ধ—এরপর তাবুকের যুদ্ধ। এভাবে খোলাফায়ে রাশিদিন, উমাইয়া, আব্বাসি ও উসমানি খেলাফতের যুগেও রোমানদের সাথে মুসলিমদের লড়াই অব্যাহত ছিল। বলতে গেলে, ইসলামের যত যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল, সব ঘটেছিল এই পূর্ব রোমান বা বাইজেনটাইন সাম্রাজ্যের সাথেই। কারণ, পৃথিবীব্যাপী ইসলামের সত্য-সুন্দর আহ্বানের বিরুদ্ধে শক্তি ও ষড়যন্ত্র, জিঘাংসা ও বিরুদ্ধতা নিয়ে প্রতিপক্ষ হিসেবে তারাই পরম্পরা ধরে দাঁড়িয়ে আসছিল। আরও অনেক প্রতিপক্ষ ছিল বটে মুসলিমদের, কিন্তু সেকালে—এবং আজও— মুসলিমদের প্রধান প্রতিপক্ষ ছিল এরাই।

সম্রাট কন্সটান্টিন

রোমান সাম্রাজ্য সম্পর্কে কিছু জানার আগে সম্রাট কন্সটান্টিন সম্বন্ধেও কিছু জানা দরকার। সম্রাট কন্সটান্টিন ছিলেন পশ্চিম রোম সম্রাট প্রথম কন্সটান্টিয়াসের পুত্র।

ব্রিটেন সফরে কন্সটান্টিয়াস মারা গেলে সৈন্যরা তাৎক্ষণিক সেখানে কন্সটান্টিনকে সম্রাট হিসেবে ঘোষণা করে। তিনি ছয় বছর ব্রিটেন ও গল শাসন করেন। অন্য দিকে সিংহাসনের আরেক দাবিদার ম্যাক্সেনটিয়াস শাসন করেন রোম।

৩১২ সালে মিলভিয়ান সেতুর যুদ্ধে ম্যাক্সেনটিয়াসকে পরাজিত ও নিহত করেন কন্সটান্টিন। যুদ্ধ শুরুর ঠিক আগমুহূর্তে তিনি দেখতে পান—আকাশে মেঘের গায়ে ক্রুশচিহ্ন; ঘটনাটি তাকে খ্রিস্টধর্মে দীক্ষিত হতে অনুপ্রাণিত করে। এরপরই তিনি প্রবর্তন করেন ধর্মীয় সহনশীলতা নীতি এবং খ্রিস্ট ধর্মালম্বীদের ওপর নির্যাতন বন্ধের ব্যবস্থা করেন। ৩২৪ সালে পূর্ব রোমান সাম্রাজ্যের সম্রাট লিসিনিয়াসকে পরাজিত করে পুরো সাম্রাজ্যের অধীশ্বর হন। এক বছর পর তিনিই প্রথম নাইসিয়া বা বর্তমান তুরস্কের ইনজিরে খ্রিস্টান গির্জাসমূহের প্রধানদের সম্মেলন আহ্বান করেন।

কন্সটান্টিন ৩৩০ সালে রোমান সাম্রাজ্যের রাজধানী পৌত্তলিক রোম থেকে সরিয়ে নতুন শহর কনসটানটিনোপলে নিয়ে যান। শহরটি তৈরি হয়েছিল বাইজেনটিয়াম তথা বর্তমান তুরস্কের বৃহত্তম নগরী ইস্তাম্বুলের গ্রাম এলাকায়।

কন্সটান্টিন যখন ৩৩০ সালে রোমান সাম্রাজ্যের রাজধানী রোম থেকে তারনতুন শহর কনসটানটিনোপলে স্থানান্তর করেন, তখন তিনি শুধু ক্ষমতার কেন্দ্রেরইপরিবর্তন ঘটাননি—৪৭৬ সালে রোমের পতনের পরও রোমান সাম্রাজ্য অব্যাহত বা টিকিয়ে রাখার পথও দেখান।

কনসটানটিনোপলের অবস্থান ছিল প্রাচীন গ্রিক বাইজেনটিয়ামের পাশে। শাসনকার্যে সুবিধার জন্য সম্রাট ডায়োকেটিয়ান রোমকে পূর্ব ও পশ্চিম, এ দুই অংশে ভাগ করেছিলেন। বিভক্তিকরণের এ উদ্দেশ্য সাময়িকভাবে সফলতার মুখ দেখলেও দিন দিন দূরত্ব বাড়তে থাকে রাজ্য-দুটির মাঝে। বহিঃশত্রুর আক্রমণ একযোগে ঠেকানোর পরিবর্তে সম্পদ ও সেনাবাহিনী নিয়ে প্রায় সময়ই তাদের গণ্ডগোল বেধে যেত।

এভাবে গ্রিকভাষী পূর্ব রোমান সাম্রাজ্য দিন দিন সম্পদের পাহাড় গড়ে তুলতে থাকে; অন্য দিকে অর্থনৈতিক অনটন ঘিরে ধরতে শুরু করে ল্যাটিনভাষী পশ্চিম ভাগকে; এমনকি পূর্ব রোমান সাম্রাজ্য তাদের বিরুদ্ধে আক্রমণোদ্যত বার্বারদের লেলিয়ে দিত পশ্চিমের দিকে। কন্সটান্টিন ও তার উত্তরসূরিরা নিশ্চিত করেছিলেন যেন পূর্ব রোমকে শত্রুর আক্রমণ থেকে সর্বোচ্চ সুরক্ষা দেওয়া যায়; কিন্তু পশ্চিম রোমান সাম্রাজ্যের ব্যাপারে নেওয়া হয়নি এমন কোনো পদক্ষেপ। এভাবে ধীরে ধীে পঞ্চম শতাব্দীতে পশ্চিম সাম্রাজ্যের রাজনৈতিক কাঠামো একপ্রকার ভেঙেই পড়েছিল।

অন্য দিকে উসমানি সাম্রাজ্যের হাতে পতনের আগ পর্যন্ত টিকে ছিল বাইজন্টাইন তথা পূর্ব সাম্রাজ্য।ইতিহাসবিদরা পূর্ব রোমান সাম্রাজ্যকে অভিহিত করেন বাইজেনটাইন সাম্রাজ্য নামে। ৫২৭ থেকে ৫৬৫ সালের মধ্যে প্রথম জাস্টিনিয়ানের শাসনকালে এই সাম্রাজ্য বহু দূর পর্যন্ত বিস্তার লাভ করেছিল। তার শক্তিমান জেনারেল নার্সেস ও বেলিসারিয়াস এই সাম্রাজ্যের বিস্তার ঘটান আনাতোলিয়া বা উপদ্বীপ, ফিলিস্তিন, মিশর, উত্তর আফরিকা, স্পেনের দক্ষিণাঞ্চল এবং ইতালির অংশবিশেষ পর্যন্ত।

জাস্টিনিয়ানের মৃত্যুর কয়েক বছর পর বাইজেনটাইন ক্রমশ সংকুচিত হয়ে আসে। জাস্টিনিয়ানের পরবর্তী শাসকদের একজন হলেন সম্রাট হেরাক্লিয়াস। তিনি ৬১০-৬৪১ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত বাইজেনটাইন সাম্রাজ্য শাসন করেন। তখন ছিল। নবুওতের যুগ। ইসলামের দাওয়াত দিয়ে তাকেই পত্র দিয়েছিলেন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়াসাল্লাম। আমাদের অজানা নয় যে, রাসুলের সে দাওয়াতের প্রেক্ষিতে কত কোণঠাসা ছিল হেরাক্লিয়াসের অবস্থান; জনগণের চাপ সামলে নিজের মতের পক্ষে জনমত জোগানোর মতো যোগ্যতা তিনি হারিয়ে ফেলেছিলেন। বোঝা যায়, সম্রাট হেরাক্লিয়াসও ছিলেন ক্রমশ সংকুচিত হয়ে আসা বাইজেনটাইন সাম্রাজ্যকালের শাসকদের একজন।

তবে বাইজেনটাইন সাম্রাজ্যের মধ্যে স্পষ্টত সংকোচন প্রতীয়মান হয় ১০৭১ সালে। ঐতিহাসিক মানজিকার্ট যুদ্ধে সেলজুক সুলতান আলপ আরসালানের হাতে বাইজেনটাইন সম্রাট রোমানোস পরাজিত হওয়ার পর। কারণ, এই বিজয়ের আনাতোলিয়ায় সেলজুকদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয় এবং সেখানে ক্রমশ সেলজুক সাম্রাজ্য বিস্তৃতি লাভ করতে থাকে; বিপরীতে বাইজেনটাইন সাম্রাজ্য ক্রমান্বরে সংকুচিত হতে থাকে। দিন দিন বাড়তেই থাকে এই সংকোচন; সেলজুক শাসনামল। হয়ে উসমানি শাসনামলে এসে তা একেবারে চূড়ান্ত পতনে রূপ নেয়।

পতনের পদধ্বনি

বাইজেনটাইন সাম্রাজ্যে খ্রিস্টধর্মের নিজস্ব বৈশিষ্ট্য ছিল; এর রক্ষক ছিল ইস্টার্ন অর্থোডক্স চার্চ। জ্ঞান-বিজ্ঞান ও শিল্প-সংস্কৃতির উন্নত কেন্দ্র ছিল এই সাম্রাজ্য। এরই ছড়িয়ে পড়েছিল দক্ষিণ ইউরোপে। পক্ষান্তরে বিলুপ্ত হওয়া পশ্চিম রোমান সাম্রাজ্যের অধীনস্থ পশ্চিম-ইউরোপের ল্যাটিনভাষী দেশগুলোর রক্ষক ছিল ক্যাথলিক চার্চ। ফলে এ বিবেচনাতেও বাইজেনটাইন সাম্রাজ্যের সাথে পশ্চিম ইউরোপের দেশগুলোর একটা বৈরী মানসিকতা কাজ করে আসছিল।

পোপ তৃতীয় ইনোসেন্ট ১১৯৮ সালে চতুর্থ ক্রুসেডের ডাক দেন। জেরুসালেম উদ্ধার করতে তার ডাকে দেয় পশ্চিম ইউরোপের দেশগুলো কিন্তু পশ্চিম ইউরোপ ও বাইজেনটাইনের ক্ষমতার দ্বন্দ্বে ক্রুসেডারদের লক্ষ হয়ে দাঁড়ায় বাইজেনটাইন সম্রাট তৃতীয় অ্যালেন্সিয়াসের স্থলে তার ভাতিজাকে সিংহাসনে বসানো, এতে তারা সফল হয়। তখন সময় ১২০৩ খ্রিস্টাব্দ। বিনিময়ে নতুন সম্রাট চতুর্থ অ্যালেক্সিয়াস বাইজেনটাইন চার্চকে রোমের অধীনস্থ করার চেষ্টা করলে সম্মুখীন হন প্রবল প্রতিরোধের। ১২০৪ সালে এক প্রাসাদ-অভ্যুত্থানে তিনি নিহত হন।

সুযোগ হাতছাড়া করতে চায়নি পশ্চিমের ক্রুসেডাররা। তারা জেরুসালেন আক্রমণ বাদ দিয়ে কনসটানটিনোপল আক্রমণ করে। এই কনসটানটিনোপল তখন পৃথিবীর ঐশ্বরিক শহর; বাইজেনটাইন সাম্রাজ্যের বিশাল ও মনোরম রাজধানী। শহরটি দখল করে সম্পূর্ণ লণ্ডভণ্ড করে ফেলে ল্যাটিন ক্রুসেডাররা। পশ্চিম রোমান চার্চের প্রতিদ্বন্দ্বী ইস্টার্ন অর্থোডক্স চার্চের অনেক ভবনে আগুন লাগিয়ে ভস্মীভূত করে দেয়। চার্চের যাজক ও নানদের ওপর চালায় অকথ্য নির্যাতন। এভাবেই চতুর্থ ক্রুসেড সমাপ্ত হয়।

১২০৪ সালের চতুর্থ ক্রুসেড ছিল বাইজেনটাইন সাম্রাজ্যের কোমরে সজোরে আঘাত করার নামান্তর। এরপর থেকে এ সাম্রাজ্য ভেঙে পড়তে থাকে। বাইজেনটাইন সাম্রাজ্যেরই ভূমিতে প্রতিষ্ঠিত সেলজুক-ই রোমের মতো ছোট একটি সাম্রাজ্যের মোকাবেলা করতে হিমশিম খেত তারা। ১৯৬১ সালে সম্রাট অষ্টম মাইকেলের সময় বাইজেনটাইন সাম্রাজ্যের অর্থনীতিতে ধস নামতে শুরু করে এবং পুনর্বার সে মর্যাদা আর তাদের হস্তগত হয়নি।

সেলজুক সাম্রাজ্যের বিলুপ্তির পর ১২৯৯ সালে প্রতিষ্ঠিত উসমানি সাম্রাজ্য। ক্রমশ আনাতোলিয়া বা এশিয়া মাইনরে রাজ্য বিস্তার করতে থাকে। ১৩৪৫ সালে উসমানিরা বাইজেনটাইন সম্রাট জন ক্যান্টাকুজেনকে সাহায্য করতে এশিয়া পেরিয়ে ইউরোপে যায়। সে সময় গৃহযুদ্ধ চলছিল। ইউরোপে পা রেখেই দ্রুত তাদের অবস্থান সুদৃঢ় করতে থাকে উসমানিরা। ১৪০০ সাল নাগাদ কয়েকটি অভিযানের পর তারা ম্যাসিডোনিয়া, সার্বিয়া এবং বুলগেরিয়া জয় করে। বাইজেনটাইন সাম্রাজ্যকে সংকুচিত করতে করতে তারা বাইজেনটিয়াম বা কনসটানটিনোপলের চৌহদ্দিতে নিয়ে আসে। তখন এর আয়তন ছিল আজকের তুরস্কের আয়তনের সমান।

১৩৬৯ সালে সম্রাট পঞ্চম জন ক্রমবর্ধমান উসমানি হুমকির মোকাবেলা করার জন্য ল্যাটিনভাষী পশ্চিম-ইউরোপের কাছে আর্থিক সহায়তা পর্যন্ত চেয়েছিলেন; কিন্তু ব্যর্থ হন তিনি। ১৪২১ সালে উসমানি সুলতান দ্বিতীয় মুরাদের উত্থান চিহ্নিত করেছিল বাইজেনটাইন সাম্রাজ্যের চূড়ান্ত অবকাশের সমাপ্তি, অবশ্য বাইজেনটিয়ামকে কিছু কালের জন্য রক্ষা করেন মোঙ্গল বীর তৈমুর লঙ। তিনি ছিলেন চোদন মানের বংশধর। ১৪০২ সালে তিনি অধিকাংশ উসমানি সাম্রাজ্য তছনছ করে। দেন। এমনকি তার মৃত্যুর পরও উসমানি সাম্রাজ্যে গৃহযুদ্ধ চলতে থাকে।

ডুবে গেল সূর্য

সুলতান দ্বিতীয় মুরাদের সুযোগ্য সন্তান দ্বিতীয় মুহাম্মদকে বাল্যকাল থেকেই শিক্ষা দীক্ষা দিতেন সেকালের খ্যাতিমান বুজুর্গ শায়খ আক শামসুদ্দিন। “অচিরেই তোমরা কন্‌সটানটিনোপল জয় করবে; সে বিজয়ী বাহিনী কতই-না উত্তম, আর কতই-না শ্রেষ্ঠ তার সেনাপতি”–কিশোর মুহাম্মদকে হাদিসটি বারবার শোনাতেন তিনি। এভাবেই বাল্যবয়সে মুহাম্মদের হৃদয়ে কনসটানটিনোপল জয় করার বীজ বপন করে দিয়েছিলেন শায়খ; আর হয়েছিলও তা-ই।

১৪৫১ সালে অদম্য ও অমিততেজী সুলতান দ্বিতীয় মুহাম্মদ বিজয়ীবেশে আবির্ভূত হন এবং উসমানি সাম্রাজের সিংহাসনে আরোহণ করেন। ১৪৫৩ সালে দেড় লাখ সৈন্য নিয়ে তিনি কনসটানটিনোপল অবরোধ করেন।তার বিশাল গোলন্দাজ বাহিনী ৬ সপ্তাহ ধরে নগরীতে গোলাবর্ষণ করতে থাকে এবং তিন দিক থেকে স্থলভাগে তুর্কিবাহিনী এবং নৌপথে তুর্কি জাহাজ আক্রমণ চালায়। ইউরোপীয় সূত্রে বলা হয়, সর্বশেষ বাইজেনটাইন সম্রাট একাদশ কন্সটান্টাইনের সৈন্যসংখ্যা ছিল আট হাজার। তা সত্ত্বেও তারা দুর্ভেদ্য প্রতিরোধ গড়ে তোলে এবং উসমানিরা চূড়ান্তভাবে হামলে পড়বার আগে চুয়ান্ন দিন পর্যন্ত তাদের প্রতিরোধ করতে সক্ষম হয়। ইতোমধ্যে নিহত হন সম্রাট কন্সটান্টাইন।

উসমানিরা নগরী জয় করে এটিকে তাদের সাম্রাজ্যের রাজধানী হিসেবে গড়ে তুলতে থাকে এবং নগরীর নাম দেয় ইসলাম্বুল, পরে ইস্তাম্বুল, মানে ইসলামের শহর। এ বিজয়মালা গলায় পরেই তিনি ইতিহাসে ‘আল-ফাতিহ’ উপাধিতে ভূষিত হন। কনসটানটিনোপল বিজয়ের মাধ্যমে বাইজেনটাইন সাম্রাজ্যের পতন ঘটে। এ পতনের মধ্য দিয়ে প্রায় এগারশ বছর ধরে টিকে থাকা বৃহত্তর রোমান সাম্রাজ্যের সূর্য চিরতরে ডুবে যায়।

উল্লেখ্য, বর্তমানে যে সমস্ত দেশ তখন বাইজেনটাইন সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল সেগুলো হলো : আলবেনিয়া, আলজেরিয়া, আর্মেনিয়া, বসনিয়া, হার্জেগোভিনা, বুলগেরিয়া; ক্রোয়েশিয়া, সাইপ্রাস, মিশর, ফ্রান্স, জর্জিয়া, গ্রিস; সিরিয়া, ইরান, লিবিয়া; লেবানন, ফিলিস্তিন, ইসরাইল; ইতালি, জর্ডান, কসোভো, মেসিডোনিয়া, মালটা, মন্টেনিগ্রো, মরক্কো, পর্তুগাল, রোমানিয়া, স্যান মারিনো, সার্বিয়া, স্লোভেনিয়া; স্পেন, তিউনিসিয়া, তুরস্ক; ইউক্রেন আর ভ্যাটিকান সিটি। উসমানি সাম্রাজ্যের হাতে বাইজেনটাইন সাম্রাজ্যের পতনের পর এসব দেশের বেশির ভাগই পরবর্তীকালে উসমানি সাম্রাজ্যের অধীনে হয়ে যায়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button